وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِىٍّ عَدُوًّۭا شَيَـٰطِينَ ٱلْإِنسِ وَٱلْجِنِّ يُوحِى بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍۢ زُخْرُفَ ٱلْقَوْلِ غُرُورًۭا ۚ وَلَوْ شَآءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ ۖ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ
আর এভাবে আমি সবসময় মনুষ্য জাতীয় শয়তান ও জিন জাতীয় শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর দুশমনে পরিণত করেছি, তারা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে পরস্পরকে চমকপ্রদ কথা বলতো। ৭৯ তোমার রব চাইলে তারা এমনটি কখনো করতো না। ৮০ কাজেই তারদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও, তারা মিথ্যা রচনা করতে থাকুক।
৭৯
অর্থাৎ আজ যদি মানুষ ও জীন সম্প্রদায়ের শয়তানরা এক জোট হয়ে তোমার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে তাহলে আশঙ্কার কোন কারণ নেই। কারন এটা কোন নতুন কথা নয়। শুধুমাত্র তোমার একার ব্যাপারে এমনটি ঘটছে না। প্রত্যেক যুগে এমনটি হয়ে এসেছে। যখনই কোন নবী দুনিয়াবাসীকে সত্য পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছেন তখনই সমস্ত শয়তানী শক্তি তাঁর মিশনকে ব্যর্থ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
“চমকপ্রদ কথা” বলতে সত্যের আহবায়ক ও তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত ও বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলার জন্য তারা যেসব কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন এবং যে সমস্ত সন্দেহ সংশয় ও আপত্তি উত্থাপন করতো সেগুলোর কথা বলা হয়েছে। তারপর এ সমস্ত কথাকে সামষ্টিকভাবে ধোঁকা ও প্রতারণা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কারণ সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সত্য বিরোধীরা যেসব অস্ত্রই ব্যবহার করে বাহ্যত সেগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ও সফল অস্ত্র মনে হলেও তা কেবল অন্যদের জন্যই নয়, তাদের নিজেদের জন্যও প্রকৃত পক্ষে একটি ধোঁকা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হয় না।
৮০
এ ব্যাপারে আমরা আগে যেসব ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছি সেগুলো ছাড়াও এখানে এ সত্যটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর ইচ্ছা ও চাওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এটিকে উপেক্ষা করতে গেলে সাধারণভাবে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দেয়। কোন জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর অনুমোদনক্রমে আত্মপ্রকাশ করার অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, আল্লাহ্ তাতে সন্তুষ্ট আছেন এবং তাকে পছন্দও করেন। আল্লাহ্ কোন ঘটনা সংঘটিত হবার অনুমতি না দিলে, তাঁর মহাপরিকল্পনায় তার সংঘটিত হবার অবকাশ না রাখলে এবং কার্যকারণসমূহকে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি সংঘটিত করার অনুকূলে সক্রিয় না করলে দুনিয়ায় কোন ঘটনা সংঘটিত হয় না। আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমোদন ছাড়া কোন চোরের চুরি, হত্যাকারীর হত্যা, জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর বিপর্যয় এবং কাফের ও মুশরিকের কুফরী ও শিরক সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে কোন মু’মিন ও মুত্তাকী ব্যক্তির ঈমান ও তাকওয়াও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। দু’ ধরনের ঘটনায় একইভাবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই সংঘটিত হয়। কিন্তু প্রথম ধরনের ঘটনায় আল্লাহ্ সন্তুষ্ট নন। আর দ্বিতীয় ধরনের ঘটনা তিনি পছন্দ করেন, ভালবাসেন এবং এর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট। যদিও কোন বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই বিশ্ব-জাহানের মালিকের ইচ্ছা কাজ করছে তবুও আলো ও আঁধার, ভাল ও মন্দ এবং সংস্কার ও বিপর্যয়ের বিপরীতমুখী শক্তিগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষশীল হবার ফলেই এ কল্যাণের পথ উন্মুক্ত হয়। তাই এ বৃহত্তর কল্যাণের ভিত্তিতেই তিনি আনুগত্য ও অবাধ্যতা, ইবরাহিমী প্রকৃতি ও নমরূদী প্রকৃতি, মূসার স্বভাব ও ফেরাউনী স্বভাব এবং মানবিক স্বভাব ও শয়তানী স্বভাব উভয়কেই কাজ করার সুযোগ দেন। তিনি নিজের স্বাধীন চেতনা ও ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টিকে (জীন ও মানুষ) ভাল ও মন্দের মধ্য থেকে কোন একটি বাছাই করে নেবার স্বাধীনতা দান করেছেন। পৃথিবীর এ কর্মশালায় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা মতো ভাল কাজ করতে পারে এবং খারাপ কাজও করতে পারে। আল্লাহর মর্জী ও ইচ্ছা যত দূর সুযোগ দেয়, যতদূর তিনি অনুমোদন দান করেন ততদূর পর্যন্ত উভয় ধরনের কর্মীরা পার্থিব উপায়-উপকরণসমূহের সমর্থন লাভ করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে একমাত্র তারাই যারা ভাল ও কল্যাণের জন্য কাজ করে আর আল্লাহর বান্দা তাঁর প্রদত্ত নির্বাচনের স্বাধীনতা ব্যবহার করে মন্দকে নয়, ভাল ও কল্যাণকে অবলম্বন করুক, এটাই আল্লাহ্ ভালবাসেন।
এ সঙ্গে একথাটিও বুঝে নিতে হবে যে, সত্যের দুশমনদের বিরোধিতামূলক কার্যকলাপের উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ্ বারবার নিজের ইচ্ছার বরাত দেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে মু’মিনদেরকে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, তোমাদের কাজের ধরনের ফেরেশতাদের মতো নয়। ফেরেশতারা কোন প্রকার বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই আল্লাহর হুকুম তামিল করছে। অন্যদিকে দৃষ্কৃতিকারী ও বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় আল্লাহর পছন্দনীয় পদ্ধতিকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালানোই হচ্ছে তোমাদের আসল কাজ। আল্লাহ্ নিজের ইচ্ছায় তাদেরকেও কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন, যারা নিজেদের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করে যাচ্ছে। আবার তোমরা যারা আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করেছো তাদেরকেও একইভাবে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ দিচ্ছেন। অবশ্য তাঁর সন্তুষ্টি, হেদায়াত, সমর্থন ও সাহায্য-সহায়তার হাত প্রসারিত হয়েছে তোমাদের দিকেই, কারণ তিনি যে কাজ পছন্দ করেন তোমরা তাই করে যাচ্ছো। কিন্তু তোমরা এ আশা করো না যে, আল্লাহ্ তাঁর প্রতি প্রাকৃতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যারা ঈমান আনতে চায় না তাদেরকে ঈমান গ্রহণে বাধ্য করবেন অথবা মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায়ের এমন সব শয়তানকে জোরপূর্বক সমস্ত পথ থেকে সরিয়ে দেবেন, যারা নিজেদের মন-মস্তিস্ক ও হাত-পায়ের শক্তি এবং নিজেদের সমস্ত উপায়-উপকরণ সত্যের পথ রোধ করার জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা কখনো হবার নয়। যদি সত্যিই তোমরা সত্য, সততা, সৎবৃত্তি ও কল্যাণের জন্য কাজ করার সংকল্প করে থাকো, তাহলে অবশ্যি তোমাদের মিথ্যা ও বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় কঠোর প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে নিজেদের সত্য প্রিয়তার প্রমাণ পেশ করতে হবে। অন্যথায় মু’জিযা, কারামতি ও অলৌকিক ক্ষমতার জোরে যদি বাতিলকে নির্মূল ও হককে বিজয়ী করাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে তো তোমাদের কোন প্রয়োজন ছিল না। আল্লাহ্ নিজেই দুনিয়ার সমস্ত শয়তানকে নির্মূল করে কুফরী ও শিরকের সম্ভাবনার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করতে পারতেন।