আল আন'আম

১৬৫ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১ ) প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উৎপত্তি ঘটিয়েছেন। তবুও সত্যের দাওয়াত অস্বীকারকারীরা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে।
ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ وَجَعَلَ ٱلظُّلُمَٰتِ وَٱلنُّورَ ثُمَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ ١
২ ) তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন জীবনের একটি সময়সীমা এবং আর একটি সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত, কিন্তু তোমরা কেবল সন্দেহেই লিপ্ত রয়েছে।
هُوَ ٱلَّذِى خَلَقَكُم مِّن طِينٍ ثُمَّ قَضَىٰٓ أَجَلًا وَأَجَلٌ مُّسَمًّى عِندَهُۥ ثُمَّ أَنتُمْ تَمْتَرُونَ ٢
৩ ) তিনিই এক আল্লাহ‌ আকাশেও আছেন এবং পৃথিবীতেও, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব অবস্থান জানেন এবং ভালো বা মন্দ যা-ই তোমাদের উপার্জন করো তাও তিনি ভালোভাবেই অবগত।
وَهُوَ ٱللَّهُ فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَفِى ٱلْأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ ٣
৪ ) মানুষের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তাদের রবের নিদর্শন সমূহের মধ্য থেকে এমন কোন নিদর্শন নেই যা তাদের সামনে আসার পর তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।
وَمَا تَأْتِيهِم مِّنْ ءَايَةٍ مِّنْ ءَايَٰتِ رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوا۟ عَنْهَا مُعْرِضِينَ ٤
৫ ) অনুরূপভাবে এখন যে সত্য তাদের কাছে এসেছে তাকেও তারা মিথ্যা বলেছে। ঠিক আছে, এতদিন পর্যন্ত যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে এসেছে শীঘ্রই সে সম্পর্কে কিছু খবর তাদের কাছে পৌঁছবে।
فَقَدْ كَذَّبُوا۟ بِٱلْحَقِّ لَمَّا جَآءَهُمْ فَسَوْفَ يَأْتِيهِمْ أَنۢبَٰٓؤُا۟ مَا كَانُوا۟ بِهِۦ يَسْتَهْزِءُونَ ٥
৬ ) তারা কি দেখেনি তাদের পূর্বে এমনি ধরনের কত মানব গোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা নিজ নিজ যুগে ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী? পৃথিবীতে তাদেরকে এমন কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম, যা তোমাদেরকেও দেইনি। তাদের ওপর আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম এবং তাদের পাদদেশে নদী প্রবাহিত করেছিলাম। (কিন্তু যখন তারা নিয়ামতের প্রতি অকৃজ্ঞতা প্রকাশ করলো তখন) অবশেষে তাদের গোনাহের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের জায়গায় পরবর্তী যুগের মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছি।
أَلَمْ يَرَوْا۟ كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ مَّكَّنَّٰهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّن لَّكُمْ وَأَرْسَلْنَا ٱلسَّمَآءَ عَلَيْهِم مِّدْرَارًا وَجَعَلْنَا ٱلْأَنْهَٰرَ تَجْرِى مِن تَحْتِهِمْ فَأَهْلَكْنَٰهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَنشَأْنَا مِنۢ بَعْدِهِمْ قَرْنًا ءَاخَرِينَ ٦
৭ ) হে নবী! যদি তোমার প্রতি কাগজে লেখা কোন কিতাবও নাযিল করতাম এবং লোকেরা নিজেদের হাত দিয়ে তা স্পর্শ করেও দেখে নিতো, তাহলেও আজ যারা সত্যকে অস্বীকার করছে তারা তখন বলতো, এটা সুস্পষ্ট যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَٰبًا فِى قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ إِنْ هَٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ ٧
৮ ) তারা বলে, এ নবীর কাছে কোন ফেরেশতা পাঠানো হয় না কেন? যদি ফেরেশতা পাঠাতাম, তাহলে এতদিনে কবেই ফায়সালা হয়ে যেতো, তখন তাদেরকে আর কোন অবকাশই দেয়া হতো না।
وَقَالُوا۟ لَوْلَآ أُنزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنزَلْنَا مَلَكًا لَّقُضِىَ ٱلْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنظَرُونَ ٨
৯ ) যদি ফেরেশতা পাঠাতাম তাহলেও তাকে মানুষের আকৃতিতেই পাঠাতাম এবং এভাবে তাদেরকে ঠিক তেমনি সংশয়ে লিপ্ত করতাম যেমন তারা এখন লিপ্ত রয়েছে।
وَلَوْ جَعَلْنَٰهُ مَلَكًا لَّجَعَلْنَٰهُ رَجُلًا وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ ٩
১০ ) হে মুহাম্মাদ! তোমার পূর্বেও অনেক রসূলের প্রতি বিদ্রূপ করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্রূপকারীরা যে অকাট্য সত্য নিয়ে বিদ্রূপ করতো, সেটাই অবশেষে তাদের ওপর চেপে বসেছিল।
وَلَقَدِ ٱسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِّن قَبْلِكَ فَحَاقَ بِٱلَّذِينَ سَخِرُوا۟ مِنْهُم مَّا كَانُوا۟ بِهِۦ يَسْتَهْزِءُونَ ١٠
১.
মনে রাখতে হবে, এখানে আরবের মুশরিকদের সম্বোধন করে বলা হচ্ছে। আর এ মুশরিকরা একথা স্বীকার করতো যে, আল্লাহ‌ পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। তিনি দিন ও রাতের উদ্ভব ঘটান। সূর্য ও চন্দ্রকে তিনিই অস্তিত্ব দান করেছেন। এ কাজগুলো লাত, উয্‌যা হোবল অথবা আর কোন দেবদেবী করেছে-এ ধরনের কোন বিশ্বাস তাদের কেউ পোষন করতো না। তাই তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছেঃ মুর্খরা! যখন তোমরা নিজেরাই একথা স্বীকার করে থাকো যে, পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ‌ এবং দিন-রাতের আবর্তন তিনিই করান তখন তোমরা আবার অন্যের সামনে সিজদা করো কেন? তাদেরকে নযরানা দাও, তাদের কাছে প্রার্থনা করো এবং নিজেদের অভাব-অভিযোগ পেশ করো কেন? এরা কারা? (সূরা ফাতহা ২ টীকা এবং সূরা আল বাকারা ১৬৩ টীকা দেখুন)।

আলোর মোকাবিলায় ‌‘অন্ধকার’ শব্দটিকে বহুবচনে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। কারণ, অন্ধকার বলা হয় আলোবিহীনতাকে আর আলোবিহীনতার রয়েছে অসংখ্য পর্যায়। তাই আলো এক বা একক এবং অন্ধকার একাধিক, বহু।

২.
মানব দেহের সমুদয় অংশ মাটি থেকে গৃহীত। এর সামান্যতম অংশও অ-মৃত্তিকা নয়। তাই বলা হয়েছে, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।
৩.
অর্থাৎ কিয়ামতের সময়। তখন আগের ও পরের সমস্ত মানুষকে আবার নতুন করে জীবিত করা হবে এবং নিজেদের সমস্ত কাজের হিসেব দেবার জন্য তারা তাদের রবের সামনে হাযির হয়ে যাবে।
৪.
এখানে হিজরত এবং হিজরতের পরে ইসলাম একের পর এক যেসব সাফল্য অর্জন করবে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যখন এ ইঙ্গিত করা হয়েছিল সে সময় কোন্ ধরনের খবর পৌঁছবে সে সম্পর্কে কাফেররা কোন কল্পনাই করতে পারেনি এবং মুসলমানদেরও এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন।
৫.
অর্থাৎ যখন এ ব্যক্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে তখন আকাশ থেকে একজন ফেরেশতাও পাঠানো উচিত ছিল। এ ফেরেশতা লোকদের ডেকে ডেকে বলবে, ইনি আল্লাহর নবী, এঁর কথা মেনে চলো, নয়তো তোমাদের শাস্তি দেয়া হবে। মূর্খ আপত্তিকারীরা অবাক হচ্ছিল এ ভেবে যে, পৃথিবী ও আকাশের মহাশক্তিশালী ও পরাক্রমশালী স্রষ্টা একজনকে নিজের পয়গম্বর নিযুক্ত করবেন এবং তাকে মানুষের গালিগালাজ ও প্রস্তরাঘাত সহ্য করার জন্য সহায় সম্বলহীনভাবে ছেড়ে দেবেন, এটা কেমন করে হতে পারে? এত বড় বাদশাহর দূত বিপুল সংখ্যক রাজকীয় ও সরকারী আমলা কর্মচারীসহ না এলেও অন্তত আরদালী হিসেবে একজন ফেরেশতাকেও তো সঙ্গে নিয়ে আসবেন। সে ফেরেশতা তাঁর হেফাজত করতো, মানুষের ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করতো, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত একথা সবাইকে বুঝাতো এবং অস্বাভাবিক ও অলৌকিক পদ্ধতিতে তাঁর দায়িত্ব সম্পাদন করতো।
৬.
এটা হচ্ছে তাদের আপত্তির প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, ঈমান আনার ও নিজেদের কর্মনীতি সংশোধন করার জন্য তোমরা যে সময়-সুযোগ ও অবকাশ লাভ করেছো এর সময়সীমা ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষন সত্য অদৃশ্যের পর্দান্তরালে গোপনে রয়েছে। নয়তো অদৃশ্যের পর্দা ছিন্ন হবার সাথে সাথেই এ অবকাশের সুযোগও শেষ হয়ে যাবে। এরপর শুধু হিসেব নেবার কাজটি বাকি থাকবে। কেননা দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য একটি পরীক্ষাকাল। পরীক্ষা হচ্ছে এ বিষয়ের যে, প্রকৃত সত্যকে না দেখে নিজেদের চিন্তা ও বৃদ্ধিবৃত্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তোমরা তাকে উপলব্ধি করতে ও জানতে পারো কি না এবং এ উপলব্ধি করার ও জানার পর নিজেদের নফস ও তার কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রকৃত সত্যের নিরীখে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সঠিক পথে চালাতে পারো কি না। এ পরীক্ষার জন্য অদৃশ্যের অদৃশ্য থাকাটা হচ্ছে একটি অপরিহার্য শর্ত। আর তোমাদের দুনিয়ার জীবন, যা আসলে পরীক্ষার অবকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়, এটিও ততক্ষণ প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে যতক্ষণ অদৃশ্য অদৃশ্যই থাকে। যখনই অদৃশ্য দৃশ্যমান হয়ে যাবে তখনই অবশ্যি এ অবকাশ খতম হয়ে যাবে। তখন পরীক্ষার পরিবর্তে পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় সমাগত হবে। কাজেই তোমাদের দাবী অনুসারে ফেরেশতাকে তার আসল চেহারায় তোমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহ এখনই তোমাদের পরীক্ষার সময়কাল শেষ করে দিতে চান না। (সূরা আল বাকারার ২২৮ টীকা দেখুন)।
৭.
এটি হচ্ছে তাদের আপত্তির দ্বিতীয় জবাব। প্রথমত ফেরেশতা তার আসল অদৃশ্য আকৃতিতে আসতে পারতো এবং এভাবে নিজেকে মানুষের সামনে প্রকাশ করতে পারতো। কিন্তু আগেই বলে দেয়া হয়েছে, এখনো তার সময় হয়নি। দ্বিতীয়ত ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরে আসতে পারতো। এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যদি সে মানুষের রূপ ধরে আসতো, তাহলে সে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হয়ে এসেছে সে ব্যাপারে তোমাদের মনে সে একই সন্দেহ ও বিভ্রম সৃষ্টিও হয়ে যেতো যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্তির ব্যাপারে তোমাদের মনে সৃষ্টি হয়েছে।
অনুবাদ: