وَكَذَٰلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٍۢ مِّنَ ٱلْمُشْرِكِينَ قَتْلَ أَوْلَـٰدِهِمْ شُرَكَآؤُهُمْ لِيُرْدُوهُمْ وَلِيَلْبِسُوا۟ عَلَيْهِمْ دِينَهُمْ ۖ وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَا فَعَلُوهُ ۖ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ
আর এভাবেই বহু মুশরিকের জন্য তাদের শরীকরা নিজেদের সন্তান হত্যা করাকে সুশোভন করে দিয়েছে, ১০৭ যাতে তাদেরকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করতে ১০৮ এবং তাদের দ্বীনকে তাদের কাছে সংশয়িত করে তুলতে পারে। ১০৯ আল্লাহ চাইলে তারা এমনটি করতো না। কাজেই তাদেরকে দাও, তারা নিজেদের মিথ্যা রচনায় ডুবে থাক। ১১০
১০৭
এখানে শরীকরা শব্দটি আগের অর্থ থেকে পৃথক অন্য একটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ওপরের আয়াতে “শরীক” শব্দটি থেকে তাদের এমনসব মাবুদদেরকে বুঝানো হয়েছিল যাদের বরকত, সুপারিশ বা মাধ্যমকে তারা নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভের কাজে সাহায্যকারী মনে করতো এবং তাদের নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা লাভের অধিকারের ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করতো। অন্যদিকে এ আয়াতে শরীক বলতে মানুষ ও শয়তানদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা সন্তান হত্যাকে তাদের দৃষ্টিতে একটি বৈধ ও পছন্দনীয় কাজে পরিণত করেছিল। তাদেরকে শরীক বলার কারণ হচ্ছে এই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে যেভাবে পূজা ও উপাসনা লাভের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ অনুরূপভাবে বান্দাদের জন্য আইন প্রণয়ন এবং বৈধ ও অবৈধের সীমা নির্ধারণ করার অধিকারও একমাত্র আল্লাহর। কাজেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর সামনে পূজা ও উপাসনার কোন অনুষ্ঠান করা যেমন তাকে আল্লাহর সাথে শরীক করার সমার্থক ঠিক তেমনি কারোর মনগড়া আইনকে সত্য মনে করে তার আনুগত্য করা এবং তার নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করাকে অপরিহার্য মনে করাও তাকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বে শরীক গণ্য করারই শামিল। এ দু’টি কাজ অবশ্যি শিরক। যে ব্যক্তি এ কাজটি করে, সে যাদের সামনে মানত ও নযরানা পেশ করে অথবা যাদের নির্ধারিত আইনকে অপরিহার্যভাবে মেনে চলে, তাদেরকে মুখে ইলাহ বা রব বলে ঘোষণা করুক বা না করুক তাতে এর শিরক হওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না।
আরববাসীদের মধ্যে সন্তান হত্যা করার তিনটি পদ্ধতির প্রচলন ছিল। কুরআনে এ তিনটির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
একঃ মেয়ের কারণে কোন ব্যক্তিকে জামাই হিসেবে গ্রহণ করতে হবে অথবা গোত্রীয় যুদ্ধে শত্রুরা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে বা অন্য কোন কারণে তার জন্য পিতা-মাতাকে লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে-এসব চিন্তায় মেয়েদের হত্যা করা হতো।
দুইঃ সন্তানদের লালন পালনের বোঝা বহন করা যাবে না এবং অর্থনৈতিক উপাদান ও সুযোগ-সুবিধার অভাবের দরুন তারা দুর্বিসহ বোঝায় পরিণত হবে-এ ভয়ে সন্তানদের হত্যা করা হতো।
তিনঃ নিজেদের উপাস্যদের সন্তুষ্টির জন্য সন্তানদের বলি দেয়া হতো।
১০৮
এ “ধ্বংস” শব্দটি এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থঃ নৈতিক ধ্বংসও হয়। যে ব্যক্তি নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার এমন এক পর্যাযে পৌঁছে যায়, যার ফলে নিজের সন্তানকে নিজের হাতে হত্যা করতে থাকে, তার মধ্যে মানবিক গুণ তো দূরের কথা পাশবিক গুণেরও অস্তিত্ব থাকে না। আবার এর অর্থঃ সম্প্রদায়গত ও জাতীয় ধ্বংসও হয়। সন্তান হত্যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বংশ হ্রাস ও জনসংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর ফলে মানব সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংশ্লিষ্ট জাতিও ধ্বংসের আবর্তে নেমে যেতে থাকে। কারণ এ জাতি নিজেদের সাহায্য, সহায়তা ও সমর্থন দানকারী, নিজেদের তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং নিজেদের উত্তরাধিকারীদের জন্মের পথ রুদ্ধ করে অথবা জন্মের পরপরই নিজেরাই নিজেদের হাতে তাদেরকে খতম করে দেয়। এছাড়া এর অর্থ পরিণামগত ধ্বংসও হয়। যে ব্যক্তি নিরপরাধ-নিষ্পাপ শিশুদের ওপর এ ধরনের জুলুম করে, নিজের মনুষ্যত্বকে এমনকি প্রাণী-সুলভ প্রকৃতিকেও এভাবে জবাই করে এবং মানব সম্প্রদায়ের সাথে ও নিজের জাতির সাথেও এ ধরনের শত্রুতা করে, সে নিজেকে আল্লাহর কঠিনতম আযাবের উপযোগী করে তোলে।
১০৯
জাহেলী যুগের আরবরা নিজেদেরকে হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের অনুসারী মনে করতো এবং এ হিসেবে নিজেদের পরিচয়ও দিতো। এ জন্য তাদের ধারণা ছিল, তারা যে ধর্মের অনুসরণ করছে সেটি আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম। কিন্তু হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কাছ থেকে যে জীবন বিধানের শিক্ষা তারা নিয়েছিল তার মধ্যে পরবর্তী বিভিন্ন শতকে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, গোত্রীয় সরদার, পরিবারের বয়োবৃদ্ধ এবং অন্যান্য লোকেরা নানান ধরনের বিশ্বাস ও কর্মের সংযোজন ঘটিয়েছে। পরবর্তী বংশধরেরা সেগুলোকেই আসল দ্বীন ও জীবন বিধানের অংশ মনে করেছে এবং ভক্তি সহকারে সেগুলো মেনে চলেছে। যেহেতু জাতীয় ঐতিহ্যে, ইতিহাসে বা কোন গ্রন্থে এমন কোন রেকর্ড সংরক্ষিত ছিল না, যা থেকে আসল ধর্ম কি ছিল এবং পরবর্তীকালে কোন সময় কে কোন বিষয়টি তাতে বৃদ্ধি করেছিল তা জানা যেতে পারে, তাই আরববাসীদের জন্য তাদের সমগ্র দ্বীনটিই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়েছিল। কোন বিষয় সম্পর্কে তারা নিশ্চয়তার সাথে একথা বলতে পারতো না যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আসল দ্বীনটি এসেছিল এটি তার অংশ এবং এ বিদআত ও ভুল রসম-রেওয়াজ অনুষ্ঠানগুলো পরবর্তীকালে এর সাথে সংযুক্ত ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বাক্যটির মধ্যে এ অবস্থারই প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে।
১১০
অর্থাৎ যদি আল্লাহ চাইতেন তারা এমনটি না করুক তাহলে তারা কখনই এমনটি করতে পারতো না। কিন্তু যেহেতু যে ব্যক্তি যে পথে চলতে চায় তাকে সে পথে চলতে দেয়াটাই ছিল আল্লাহর ইচ্ছা তাই এসব কিছু হয়েছে। কাজেই যদি তোমাদের বুঝাবার পর এরা না মানে এবং নিজেদের মিথ্যাচার ও মিথ্যা রচনার ওপর তারা জোর দিয়ে যেতে থাকে, তাহলে তারা যা করতে চায় করতে দাও। তাদের পেছনে লেগে থাকার কোন প্রয়োজন নেই।