যে ধরনের বাচনভংগী প্রয়োগের মাধ্যমে এ ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে তাতে সাধারণ লোকদের মনে এক প্রকার সন্দেহ জাগে। বলা হয়েছেঃ যখন রাত হয়ে গেলো, সে একটি তারকা দেখলো আবার যখন তা ডুবে গেলো তখন একথা বললো। তারপর যখন চাঁদ দেখলো এবং পরে তা ডুবে গেলো তখন একথা বললো। এরপর সূর্য দেখলো এবং যখন তাও ডুবে গেলো তখন একথা বললো। ঘটনা বর্ণনার এ পদ্ধতি একজন সাধারণ পাঠকের মনে এ প্রশ্ন সৃষ্টি করে যে, ছোট বেলায় জ্ঞান চক্ষু উন্মেলিত হবার পর থেকেই কি প্রতিদিন হযরত ইবরাহীম দিনের পরে রাত হতে দেখতেন না? তিনি কি প্রতিদিন সূর্য, চন্দ্র ও তারকাদের উদিত ও অস্তমিত হতে দেখতেন না? আর একথা তো সুস্পষ্ট যে, এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরই করেছেন। তাহলে এ ঘটনাটি এভাবে বলা হয়েছে কেন যে, রাত হলে এই দেখলেন এবং দিন হলে এই দেখলেন? যেন মনে হচ্ছে, এ বিশেষ ঘটনাটির আগে তাঁর এসব দেখার সুযোগ হয়নি। অথচ একথা মোটেই সত্য নয়। অনেকের কাছে এ সন্দেহের নিরসন এমনই অসাধ্য মনে হয়েছে যে, তারা এর জবাব দেবার জন্য হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্ম ও প্রতিপালন সম্পর্কে একটি অস্বাভাবিক গল্প ফেঁদে বসা ছাড়া আর কোন উপায়ই দেখেননি। তাদের সেই গল্পে বলা হয়েছেঃ হযরত ইবরাহীমের জন্ম ও প্রতিপালন হয় একটি গূহার মধ্যে। সেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে পর্যন্ত তাঁকে চন্দ্র, সূর্য, তারকার দর্শণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। অথচ কথা এখানে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। একথা বোঝার জন্য এ ধরনের গল্প তৈরী করার কোন প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানী নিউটন সম্পর্কে বহুল প্রচলিত ঘটনা, তিনি একদিন একটি বাগানে গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখেন আকস্মাত তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, আপেলটি আকাশে না উঠে মাটিতে পড়লো কেন? এর ওপর চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনাটির পূর্বে নিউটন কি কখনো কোন জিনিস ওপর থেকে নীচে পড়তে দেখেননি? অবশ্যই দেখেছেন? বহুবার দেখেছেন। তাহলে কি কারণে সেই একটি বিশেষ দিনে বিশেষ সময়ে আপেলটি মাটিতে পড়ার ঘটনা নিউটনের মনে এমন প্রশ্ন সৃষ্টি করে যা, ইতিপূর্বে প্রতিদিন শত শত বার এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও তার মনে সৃষ্টি হয়নি? এর একমাত্র জওয়াব এই যে, চিন্তা-ভাবনাকারী ও অনুসন্ধানী মন সবসময় এক ধরনের পর্যবেক্ষন থেকে একইভাবে আলোড়িত হয় না। অনেক সময়ই এমন হতে দেখা গেছে, একটি জিনিস মানুষ ক্রমাগতভাবে দেখতে থাকে কিন্তু তার মনকে কোনভাবে নাড়া দেয় না। কিন্তু অন্য এক সময় সেই একই জিনিস দেখে তার মনে হঠাৎ একটি প্রশ্ন জাগে এবং তার ফলে তার চিন্তাশক্তিগুলো একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অথবা প্রথম থেকে কোন একটি বিষয়ের অনুসন্ধানে মনে খট্কা বা জটিলতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রতিদিনকার বারবার দেখা একটি জিনিসের ওপর নজর পড়ার সাথে সাথেই জটিল গ্রন্থী উন্মোচনের সূত্র হাতে এসে যায় আর তারপর সবকিছু পানির মত তরল মনে হয়। হযরত ইবরাহীমের ঘটনাটিও এ ধরনের। রাত প্রতিদিন আসতো এবং চলেও যেতো। সূর্য, চন্দ্র, তারকা প্রতিদিন চোখের সামনে উদিত ও অস্তমিত হতো। কিন্তু সেটি ছিল একটি বিশেষ দিন যেদিন একটি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ হযরত ইবরাহীমের চিন্তা ও দৃষ্টিকে এমন একটি পথে পরিচালিত করে যার ফলে অবশেষে তিনি মহান আল্লাহর একত্বের (তাওহীদ) কেন্দ্রীয় সত্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। হতে পারে হযরত ইবরাহীম (আ) প্রথম থেকে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আসছিলেন যে, যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁর জাতির সমগ্র জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে তার মধ্যে কতটুকু সত্যতা আছে? আর এ অবস্থায় অকস্মাত আকাশের একটি নক্ষত্রের উদয়াস্ত তাঁর চিন্তার সমস্ত জট খুলে দিয়ে যায়। প্রকৃত সত্য তাঁর সামনে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবার এইও হতে পারে, নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের ফলেই তাঁর মনে প্রথম চিন্তার উন্মেষ ঘটে।
এ প্রসঙ্গে আর একটি প্রশ্নও দেখা দেয়। সেটি হচ্ছে, হযরত ইবরাহীম (আ) যখন তারকা দেখে বলেন, এ আমার রব আবার যখন চাঁদ ও সূর্য দেখে তাদেরকেও নিজের রব বলে ঘোষণা দেন, সে সময় কি তিনি সাময়িকভাবে হলেও শিরকে লিপ্ত হননি? এর জওয়াব হচ্ছে, একজন সত্যসন্ধানী তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে পরিভ্রমণকালে মাঝপথে যেসব মনযিলে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য থামে আসল গুরুত্ব সে মনযিলগুলোর নয় বরং আসল গুরুত্ব হচ্ছে সে গন্তব্যের যে দিকে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন এবং যেখানে গিয়ে তিনি অবস্থান করেন। মাঝখানের এ মনযিলগুলো অতিক্রম করা প্রত্যেক সত্যসন্ধানীর জন্য অপরিহার্য। সেখানে অবস্থান হয় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে, অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে অবস্থান করা হয় না। মূলত এ অবস্থান হয় জিজ্ঞাসা সূচক ও প্রশ্নবোধক, সিদ্ধান্তমূলক নয়। অনুসন্ধানী যখন এ মনযিলগুলোর কোনটিতে অবস্থান করে বলেন, “ব্যাপারটি এমন” তখন এটি মূলত তার শেষ সিদ্ধান্ত হয় না বরং তার একথা বলার উদ্দেশ্য হয়, জিজ্ঞাসা মূলক। অর্থাৎ “ব্যাপারটি কি এমন? ” তারপর পরবর্তী অনুসন্ধানে এর নেতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। তাই পথের মাঝখানে যেখানে যেখানে থামেন সেখানেই তিনি সাময়িকভাবে কুফরী বা শিরক করেন একথা সম্পূর্ণ ভুল। কাজেই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে কোন প্রকার শিরকে লিপ্ত হননি।