مَالَتْ عَنِ الْوَاجِبِ مِنْ مُوَافِقَتِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَحِبُّ مَا يُحِبُّهُ وَكِرَاهَةَ مَايَكْرَهُهُ اِلَى مُخَالِفَتِهِ-
অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ﷺ যা পছন্দ করেন তা পছন্দ করা এবং যা অপছন্দ করেন তা অপছন্দ করার ব্যাপারে তাঁর সাথে মিল রেখে চলা তোমাদের জন্য অবশ্য করণীয়। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমাদের মন তাঁর সাথে সাজুয্য রক্ষা করে চলা থেকে বিচ্যুত হয়ে তাঁর বিরোধিতা করার দিকে বেঁকে গিয়েছে।
আয়াতে স্পষ্টভাবে দুই জন মহিলাকে সম্বোধন করা হয়েছে। আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে জানা যায় যে, ঐ দু’জন মহিলা ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এই সূরার প্রথম আয়াত থেকে পঞ্চম আয়াত পর্যন্ত একাদিক্রমে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের বিষয়াদিই আলোচিত হয়েছে। কুরআন মজীদের বাচনভঙ্গি থেকে এতটুকু বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে। এখন প্রশ্ন ঐ দু’জন স্ত্রী ছিলেন কে কে? আর যে কারণে এ তিরস্কার করা হলো সেই বিষয়টিই বা কি ছিল। এ বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা আমরা হাদীস শরীফে দেখতে পাই। মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসায়ী হাদীস গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস কর্তৃক একটি বিস্তারিত বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে যাতে কিছুটা শাব্দিক তারতম্য সহ এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেনঃ
আমি অনেক দিন থেকে মনে করছিলাম হযরত উমরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করবো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে যে দু’জন তাঁর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন এবং যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেছিলেন إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا তারা কে? কিন্তু তার ভয়াল ব্যক্তিত্বের কারণে আমার সে সাহস হতো না। শেষ পর্যন্ত হজ্জ্বে গেলে আমিও তাঁর সাথে গেলাম। ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে এক জায়গায় তাঁকে অযু করানোর সময় আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম এবং বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেনঃ তাঁরা ছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হাফসা (রাঃ)। তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন, আমরা কুরাইশীরা আমাদের স্ত্রীদের দমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিলাম। আমরা মদীনায় আসলে এখানে এমন অনেক লোক পেলাম যাদের স্ত্রীরা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ছিল। ফলে আমাদের স্ত্রীরাও তাদের থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলো। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হলে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, সে-ও আমাকে পাল্টা জবাব দিচ্ছে (মুল ভাষা হচ্ছে فاذا هى تراجعنى )। সে আমার কথার প্রত্যুত্তর করলো---এটা আমার অত্যন্ত খারাপ লাগলো। সে বললোঃ আমি আপনার কথার প্রত্যুত্তর করছি তাতে আপনি রাগান্বিত হচ্ছেন কেন? আল্লাহর শপথ! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ তো তাঁকে কথায় কথায় জবাব দিয়ে থাকেন (মুল ভাষা হচ্ছে ليراجعنه )। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নবীর ﷺ প্রতি সারা দিন অসন্তুষ্ট থাকেন (বুখারীর বর্ণনায় আছে নবী ﷺ সারা দিন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন)। এ কথা শুনে আমি বাড়ী থেকে বের হলাম এবং হাফসার (রাঃ) কাছে গেলাম। [হযরত উমরের (রা) কন্যা এবং নবীর ﷺ স্ত্রী।] আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ তুমি কি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার প্রত্যুত্তর করো? সে বললোঃ হাঁ। আমি আরো জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের মধ্যে কেউ কি সারাদিন নবীর ﷺ প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে? [বুখারীর বর্ণনা হচ্ছে, নবী ﷺ সারা দিন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন।] সে বললোঃ হাঁ। আমি বললামঃ তোমাদের মধ্য থেকে যে মহিলা এরূপ করে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তোমাদের মন থেকে কি এ ভয় দূর হয়ে গিয়েছে যে, আল্লাহর রসূলের অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহও তার প্রতি অসন্তুষ্টি হবেন এবং সে ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হবে? কখনো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার প্রত্যুত্তর করবে না। (এখানেও একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে لاتراجعى এবং তাঁর কাছে কোন জিনিসের দাবীও করবে না। আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা তুমি চেয়ে নিও। তোমার সতীন [অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রাঃ)] তোমার চাইতে অধিক সুন্দরী এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অধিক প্রিয়। তাঁর কারণে তুমি আত্মপ্রতারিত হয়ো না। এরপর আমি সেখান থেকে বের হয়ে উম্মে সালামার (রাঃ) কাছে গেলাম এবং এ ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বললাম। তিনি ছিলেন আমার আত্মীয়া। তিনি আমাকে বললেনঃ খাত্তাবের বেটা; তুমি তো দেখছি অদ্ভূত লোক! প্রত্যেক ব্যাপারে তুমি হস্তক্ষেপ করছ! এমন কি এখন রসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতে চলেছ। তাঁর এই কথায় আমি সাহস হারিয়ে ফেললাম। এরপর হঠাৎ আমার এক আনসার প্রতিবেশী রাত্রি বেলায় আমার বাড়ীতে এসে আমাকে ডাকলেন। আমরা দু’জন পালা করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে হাজির হতাম এবং যার পালার দিন যে কথা হতো তা একে অপরকে বলতাম। এই সময়টা ছিল এমন যখন আমাদের বিরুদ্ধে গাসসানীদের আক্রমনের বিপদাশংকা দেখা দিয়েছিল। তার আহবানে আমি বের হলে সে বললঃ একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ গাসসানীরা কি আক্রমণ করে বসেছে? সে বললঃ না তার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। আমি বললামঃ হাফসা ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বুখারীর ভাষা হচ্ছেঃ رَغَمَ أَنْفُ حَفْصَةَ وَعَائِشَةَ এমনটা ঘটবে আমি প্রথমেই আশঙ্কা করেছিলাম।
কাহিনীর পরবর্তী অংশ আমরা উল্লেখ করলাম না। এ অংশে হযরত উমর (রাঃ) বলেছেনঃ তিনি পরদিন সকালে নবীর ﷺ খেদমতে হাজির হয়ে কিভাবে তাঁর ক্রোধ নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমরা মুসনাদে আহমাদ ও বুখারীর বর্ণিত হাদীসসমূহ একত্রিত করে এ কাহিনী বিন্যস্ত করেছি। এতে হযরত উমর (রাঃ) যে مراجعت শব্দ ব্যবহার করেছেন এখানে তার আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে না। বরং পূর্বাপর বিষয় থেকে আপনা আপনি প্রকাশ পায় যে, এ শব্দটি প্রতি উত্তর বা কথার পৃষ্ঠে কথা বলা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং হযরত উমরের (রাঃ) তাঁর কন্যাকে لاتراجعى رسول الله বলাটা স্পষ্টতঃ এ অর্থে বলা হয়েছে যে, নবীর ﷺ সাথে বাদানুবাদ করো না। কেউ কেউ এই অনুবাদকে ভুল বলে থাকেন। তাদের আপত্তি হচ্ছে, مراجعت শব্দের অর্থ পাল্টা জবাব দেয়া অথবা কথার পৃষ্ঠে কথা বলা ঠিক, কিন্তু বাদানুবাদ করা ঠিক নয়। কিন্তু আপত্তিকারী এ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়টি উপলব্ধি করেন না যে, কম মর্যাদার লোক যদি তার চেয়ে বড় মর্যাদার ব্যক্তিকে পাল্টা জবাব দেয় কিংবা কথার পৃষ্ঠে কথা বলে তাহলে তাকেই বাদানুবাদ করা বলে। উহাদরণস্বরূপ, বাপ যদি ছেলেকে কোন কারণে তিরস্কার বা শাসন করে অথবা তাঁর কোন কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আর ছেলে যদি তাতে আদবের সাথে চুপ থাকা বা ওজর পেশ করার পরিবর্তে পাল্টা জবাব দিতে থাকে, তাহলে একে বাদানুবাদ ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। কিন্তু ব্যাপারটা যখন বাপ এবং ছেলের মধ্যেকার না হয়ে বরং আল্লাহর রসূল এবং তাঁর উম্মাতের কোন লোকের মধ্যেকার ব্যাপার হয় তাহলে একজন নির্বোধই কেবল এ কথা বলতে পারে যে, এটা বাদানুবাদ নয়।
আমাদের এই অনুবাদকে কিছু লোক বেআদবী বা অশিষ্টতা বলে আখ্যায়িত করে। অথচ তা বেআদবী কেবল তখনই হতো যদি আমরা হযরত হাফসা (রাঃ) সম্পর্কে নিজের পক্ষ থেকে এ ধরনের ভাষা প্রয়োগ করার দুঃসাহস দেখাতাম। আমরা তো হযরত উমরের (রাঃ) কথার সঠিক অর্থ তুলে ধরেছি। আর তিনি তাঁর মেয়েকে তার ত্রুটির জন্য তিরস্কার করতে গিয়ে এ কথাটি বলেছেন। একে বেআদবী বলার অর্থ হচ্ছে, হয় পিতাও তার নিজের মেয়েকে শাসন বা তিরস্কারের সময় আদবের সাথে কথা বলবে অথবা তার তিরস্কার মিশ্রিত ভাষার অনুবাদকারীর নিজের পক্ষ থেকে মার্জিত ও শিষ্ট ভাষা বানিয়ে দেবে।
এক্ষেত্রে সত্যিকার ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, ব্যাপারটা যদি এ রকম হালকা ও মামুলী ধরনের হতো যে, নবী ﷺ তাঁর স্ত্রীদের কিছু বললে তাঁরা পাল্টা জবাব দিতেন, তাহলে তাকে এতো গুরুত্ব কেন দেয়া হলো যে, কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা নিজে সরাসরি নবীর ﷺ ঐ স্ত্রীদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন? আর হযরত উমরই (রাঃ) বা এ বিষয়টিকে এত মারাত্মক মনে করলেন কেন যে, প্রথমে নিজের মেয়েকে তিরস্কার করলেন এবং তারপর এক এক করে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীগণের প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে তাঁদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয় দেখিয়ে সাবধান করলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর মতে রসূলুল্লাহ ﷺ কি এমন চড়া মেজাজের ছিলেন যে, অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারেও স্ত্রীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন? তাছাড়া (মা’য়াযাল্লাহ) তাঁর দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেজাজ এতই কঠোর ছিল যে, এ ধরনের কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি একবার সব স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার নিজের কুঠরিতে নির্জন জীবন গ্রহণ করেছিলেন, কেউ যদি এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সে অবশ্যই দু’টি পথের যে কোন একটি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। হয় তার কাছে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের সম্মান ও মর্যাদার বিষয় এত বড় হয়ে দেখা দেবে যে, সে এজন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দোষ-ত্রুটিরও পরোয়া করবে না। অথবা সোজাসুজি এ কথা মেনে নিতে হবে যে, সেই সময় নবীর ﷺ ঐসব পবিত্র স্ত্রীদের আচরণ প্রকৃতই এমন আপত্তিকর হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপারে রসূলের ভূমিকা ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং তাঁর চেয়ে অধিক ন্যায়সঙ্গত ছিল আল্লাহ তা’আলার ভূমিকা যে কারণে নবীর ﷺ পবিত্র স্ত্রীদের এই আচরণ সম্পর্কে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন।