আল ফজর

৩০ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১ ) ফজরের কসম,
وَٱلْفَجْرِ ١
২ ) দশটি রাতের,
وَلَيَالٍ عَشْرٍ ٢
৩ ) জোড় ও বেজোড়ের
وَٱلشَّفْعِ وَٱلْوَتْرِ ٣
৪ ) এবং রাতের কসম যখন তা বিদায় নিতে থাকে।
وَٱلَّيْلِ إِذَا يَسْرِ ٤
৫ ) এর মধ্যে কোন বুদ্ধিমানের জন্য কি কোন কসম আছে?
هَلْ فِى ذَٰلِكَ قَسَمٌ لِّذِى حِجْرٍ ٥
৬ ) তুমি কি দেখনি
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ ٦
৭ ) তোমার রব সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী আদে-ইরামের সাথে কি আচরণ করেছেন,
إِرَمَ ذَاتِ ٱلْعِمَادِ ٧
৮ ) যাদের মতো কোন জাতি দুনিয়ার কোন দেশে সৃষ্টি করা হয়নি?
ٱلَّتِى لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِى ٱلْبِلَٰدِ ٨
৯ ) আর সামূদের সাথে, যারা উপত্যকায় পাথর কেটে গৃহ নির্মাণকরেছিল?
وَثَمُودَ ٱلَّذِينَ جَابُوا۟ ٱلصَّخْرَ بِٱلْوَادِ ٩
১০ ) আর কীলকধারী ফেরাউনের সাথে?
وَفِرْعَوْنَ ذِى ٱلْأَوْتَادِ ١٠
১.
এই আয়াগুলোর ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণের মধ্যে ব্যাপক মত বিরোধ দেখা যায়। এমন কি জোড় ও বেজোড় সম্পর্কে ছত্রিশটি বক্তব্য পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় এগুলোর ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেও সম্পর্কিত করা হয়েছে। কিন্তু আসলে রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোন ব্যাখ্যা প্রমাণিত নেই। নয়তো তাঁর ব্যাখ্যার পর সাহাবা, তাবেঈ ও পরবর্তী তাফসীরকারদের মধ্য থেকে কোন একজনও এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা নির্ধারণ করার সাহস করতেন না।

বর্ণনা ভংগি সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায়, প্রথম থেকে কোন আলোচনা চলছিল। সেখানে রসূলুল্লাহ ﷺ একটি কথা পেশ করছিলেন এবং অস্বীকারকারীরা তা অস্বীকার করছিল। এ প্রসঙ্গে রসূলের কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলা হয়েছে, ওমুক ওমুক জিনিসের কসম। এর অর্থ ছিল, এই জিনিসগুলোর কসম, যা কিছু মুহাম্মাদ ﷺ বলছেন সব সত্য। তারপর এ প্রশ্নের ভিত্তিতে এ বক্তব্য পেশ করা হয়েছে যে, কোন বুদ্ধিমান লোকের জন্য কি এর মধ্যে কোন কসম আছে? অর্থাৎ এই সত্য কথাটির পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্য এরপর কি আর কোন কসমের প্রয়োজন আছে? মুহাম্মাদ ﷺ যে কথা বলছেন তা জেনে নেবার জন্য কি একজন বুদ্ধি-বিবেকমান ব্যক্তির জন্য এই কসমই যথেষ্ট নয়?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রসঙ্গে এই চারটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা কি ছিল? এজন্য আমাদের পরবর্তী আয়াতগুলোতে “তুমি কি দেখনি তোমার রব তাদের সাথে কি ব্যবহার করেছিলেন” থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত সমগ্র আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এ থেকে জানা যায়, আলোচনা চলছিল শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে। মক্কাবাসীরা একথা অস্বীকার করছিল এবং রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের থেকে এর স্বীকৃতি আদায় করার জন্য অনবরত তাদেরকে দাওয়াত ও উপদেশ দিয়ে চলছিলেন। এজন্য ফজর, দশটি রাত, জোড়-বেজোড় এবং বিদায়ী রাতের কসম খেয়ে বলা হয়েছে, এই বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য এই চারটি জিনিস যথেষ্ট নয় কি? এজন্য কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির সামনে কি আর কোন জিনিস পেশ করার প্রয়োজন আছে?

এই কসমগুলোর এই পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী আলোচনা এগুলোর যে অর্থ নির্দেশ করে আমাদের অপরিহার্যভাবে সেই অর্থই গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে বলা হয়েছে “ফজরের কসম”। ফজর বলা হয় প্রভাত হয়ে যাওয়াকে। অর্থাৎ যখন রাতের অন্ধকারা ভেদ করে দিনের প্রথম আলোক রশ্মি পূর্বদিগন্তে একটি সাদা রেখার মতো আত্মপ্রকাশ করে। তারপর বলা হয়েছে “দশটি রাতের কসম”। ধারাবাহিক বর্ণনাগুলো সামনে রাখলে জানা যায়, এর অর্থ হচ্ছে মাসের তিরিশটি রাতের প্রত্যেক দশটি রাত। প্রথম দশটি রাতের চাঁদ সরু কাস্তের আকারে শুরু হয়ে প্রতি রাতে বাড়তে থাকে। এভাবে তার অর্ধেকেরও বেশী এলাকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দশটি রাতে চাঁদের আলোয় রাতের বৃহত্তম অংশ আলোকিত থাকে। শেষ দশটি রাতে চাঁদ আস্তে আস্তে একেবারে ছোট হয়ে যেতে থাকে এবং রাতের বেশীর ভাগ অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। এমনকি মাসের শেষ রাতটি হয় পুরোপুরি অন্ধকার। এরপর বলা হয়েছে, “জোড় ও বেজোড়ের কসম”। জোড় বলা হয় এমন সংখ্যাকে যাকে দু’টি সমান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ২, ৪, ৬, ১০। অন্যদিকে বেজোড় বলা হয় এমন স্যংখ্যাকে যাকে সমান দু’ভাগে ভাগ করা যায় না। যেমন ১, ৩, ৫, ৭, ৯। সাধারণভাবে দেখলে এর অর্থ হতে পারে বিশ্ব-জাহানের সমস্ত জিনিস। কারণ প্রতিটি জিনিস হয় জোড়, নয় বেজোড়। কিন্তু যেহেতু এখানে দিন ও রাতের কথা আলোচনা হচ্ছে তাই বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে এখানে জোড় ও বেজোড় মানে হচ্ছে, দিন-রাত্রির পরিবর্তন। অর্থাৎ মাসের তারিখ এক থেকে দুই এবং দুই থেকে তিন হয়ে যায়। আর প্রত্যেকটি পরিবর্তন একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি করে। সবশেষে বলা হয়েছে, “রাতের কসম যখন তা বিদায় নিতে থাকে”। অর্থাৎ সূর্য ডোবার পর থেকে পৃথিবীর বুকে যে অন্ধকার ছেয়ে ছিল তার অবসান ঘটেছে এবং আলোকময় ঊষার উদায় হতে যাচ্ছে।

এখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাস্তি ও পুরস্কারের যে খবর দিচ্ছিলেন তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য যে চারটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তাদের ওপর একবার সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করুন। এসব জিনিস এই সত্যটি প্রমাণ করছে যে, একজন মহাশক্তিশালী স্রষ্টা এই বিশ্ব-জাহানের ওপর রাজত্ব করছেন। তিনি যে কাজটিই করছেন, তা উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন, অর্থহীন নয় এবং তার পেছনে কোন বিজ্ঞতাপূর্ণ পরিকল্পনা নেই একথা বলা যাবে না। বরং তাঁর প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনা সক্রিয় রয়েছে। তাঁর পৃথিবীতে কখনো এমন দেখা যাবে না যে, এখনই রাত আবার এখনই হঠাৎ সূর্য একেবারে মাথার ওপর উঠেছে। অথবা একদিন চাঁদ উঠলো কাস্তের মতো সরু হয়ে এবং তারপর একে বারে গোল থালার মতো পূর্ণচন্দ্র আকাশে শোভা পেতে লাগলো। অথবারাত এলো কিন্তু তা আর শেষই হচ্ছে না, স্থায়ীভাবে ঠায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। অথবা আদতে দিন-রাত্রির পরিবর্তনের কোন স্থায়ী ব্যবস্থাই নেই। যার ফলে তারিখের হিসাব রাখা যায় না। আজ কোন্ মাসের কয় তারিখ, কোন্ তারিখে কোন্ কাজটি শুরু করা হয়েছিল এবং কবে খতম হবে, গ্রীষ্মকাল কবে থেকে শুরু হচ্ছে এবং বর্ষাকাল ও শীতকাল কবে আসবে---এসব জানা সম্ভব হয় না। বিশ্ব-জাহানের অন্যান্য অসংখ্য জিনিস বাদ দিয়ে মানুষ যদি শুধুমাত্র দিন-রাত্রির এই যথা নিয়মে যাওয়া আসার বিষয়টি মনোযোগ সহকারে দেখে এবং এ ব্যাপারটি নিয়ে একটু মাথা ঘামায়, তাহলে এক সর্বশক্তিমান সত্তা যে এই বিরাট নিয়ম শৃংখলা ও আইনের রাজত্ব কায়েম করেছেন এবং এই নিয়ম-শৃংখলার সাথে এখানে সৃষ্টজীবের অসংখ্য স্বার্থ ও কর্মপ্রবাহ জড়িত তার সাক্ষ্য-প্রমাণ সে এর মধ্যেই পেয়ে যাবে। এখন এই ধরনের জ্ঞানবান ও বিজ্ঞানময় এবং মহাশক্তিধর স্রষ্টার আখেরাতে শাস্তি ও পুরস্কার দেবার বিষয়টি যদি দুনিয়ার কোন মানুষ অস্বীকার করে তাহলে সে দু’টি নির্বুদ্ধিতার মধ্য থেকে কোন একটিতে অবশ্যি লিপ্ত। হয় সে তাঁর ক্ষমতা অস্বীকার করে এবং মনে করে তিনি এই অকল্পনীয় নিয়ম-শৃংখলা সহকারে এই বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন কিন্তু মানুষকে পুনর্বার সৃষ্টি করে তাকে শাস্তি ও পুরস্কার দান করার ক্ষমতা তাঁর নেই অথবা সে তাঁর জ্ঞানবত্তা ও বিজ্ঞানময়তা অস্বীকার করে এবং তাঁর সম্পর্কে একথা মনে করে নিয়েছে যে, তিনি মানুষকে দুনিয়ায় বুদ্ধি-বিবেক ও ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি কখনো তার কাছ থেকে এই বুদ্ধি-বিবেক ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারকে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে তার হিসেব নেবেন না। আর তিনি ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন না এবং খারাপ কাজের শাস্তিও দেবেন না। এই দু’টি কথার কোন একটিকেও যে ব্যক্তি মেনে নেবে সে একজন প্রথম শ্রেণীর নির্বোধ।

২.
দিন-রাত্রির আবর্তন ব্যবস্থা থেকে শাস্তি ও পুরস্কার বিধানের প্রমাণ পেশ করার পর এখন তার নিশ্চিত সত্য হবার ব্যাপারে মানুষের ইতিহাস থেকে প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। ইতিহাসের কয়েকটি পরিচিত জাতির কর্মপদ্ধতি ও তাদের পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে একথা বলার উদ্দেশ্যে যে, এই বিশ্ব-জাহান কোন অন্ধ ও বধির প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে না। বরং এক বিজ্ঞানময় আল্লাহ এই সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন। আর এই আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যে তোমরা যাকে প্রাকৃতিক আইন মনে করো কেবল মাত্র সেই আইনটিই সক্রিয় নেই বরং এই সাথে একটি নৈতিক আইনও এখানে সক্রিয় রয়েছে, যার অনিবার্যদাবী হচ্ছে, কাজের প্রতিফল এবং শাস্তি ও পুরস্কার দান। এই আইন যে সক্রিয় রয়েছে তার চিহ্ন এই দুনিয়াতেই বার বার প্রকাশ হতে থেকেছে এবং তা থেকে বুদ্ধি-বিবেকবান মানুষ বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও স্বভাব সুস্পষ্টভাবে জানতে পেরেছে। এখানে যেসব জাতি আখেরাতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এবং আল্লাহর শাস্তি ও পুরস্কারের ভয় না করেই নিজেদের জীবনের ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে তারা পরিণামে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর যে জাতিই এ পথে চলেছে বিশ্ব-জাহানের রব তার ওপর শেষ পর্যন্ত আযাবের চাবুক বর্ষণ করেছেন। মানুষের ইতিহাসের এই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার দু’টি কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছেঃ এক, আখেরাত অস্বীকার করার কারণে প্রত্যেক জাতি বিপথে পরিচালিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ততা তাকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করেছে। কাজেই আখেরাত একটি যথার্থ সত্য। প্রত্যেক সত্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার যে ভয়াবহ পরিণতি হয় এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ফলও তাই হয়। দুই, কর্মফল কোন এক সময় পূর্ণ মাত্রায়ও দেয়া হবে। কারণ বিপর্যয় ও বিকৃতির শেষ পর্যায়ে এসে আযাবের চাবুক যাদের ওপর বর্ষিত হয়েছে তাদের পূর্বে শত শত বছর পর্যন্ত বহু লোক এই বিপর্যয়ের বীজ বপন করে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল এবং তাদের ওপর কোন আযাব আসেনি। আল্লাহর ইনসাফের দাবী এই যে, কোন এক সময় তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক এবং তারা কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক। (কুরআন মজীদে আখেরাতের ব্যাপারে এই ঐতিহাসিক ও নৈতিক যুক্তির বিশ্লেষণ বিভিন্ন জায়গায় করা হয়েছে এবং সব জায়গায় আমি এর ব্যাখ্যা করেছি। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত জায়গাগুলো দেখুনঃ তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আরাফ ৫-৬ টীকা, ইউনুস ১২, হূদ ৫৭, ১০৫, ১১৫ টীকা, ইবরাহীম ৯ টীকা, আন নহল ৬৬ ও ৮৬ টীকা, আর রূম ৮ টীকা, সাবা ২৫ টীকা, সাদ ২৯ ও ৩০ টীকা, আল মু’মিন ৮০ টীকা, আদ দুখান ৩৩ ও ৩৪ টীকা, আল জাসিয়াহ-২৭ ও ২৮ টীকা, কাফ ১৭ টীকা এবং আয যারিয়াত ২১ টীকা।)
৩.
‘আদে ইরাম’ বলতে আদ জাতির সেই প্রাচীন ধারাটির কথা বুঝানো হয়েছে যাকে কুরআন মজীদ ও আরবের ইতিহাসে ‘আদে উলা’ (প্রথম) বলা হয়েছে। সূরা আন নাজমে বলা হয়েছেঃ ( وَاِنَّهُ اَهْاَكَ عَادَانِ الُوْلى ) “আর তিনি প্রাচীন আদ জাতিকে ধ্বংস করেছেন।” (৫০ আয়াত) অর্থাৎ সেই আদ জাতিকে যাদের কাছে হযরত হূদ আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছিল এবং যাদের ওপর আযাব নাযিল হয়েছিল। অন্যদিকে এই জাতির যেসব লোক আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার পর নিজেদের জাতি সত্তার সমৃদ্ধি সাধন করেছিল, আরবের ইতিহাসে তাদেরকে ‘আদ উখ্রা’ (দ্বিতীয় আদ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাচীন আদ জাতিকে “আদে ইরাম” বলার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা সিরিয় বংশজাত আদদের সেই বংশধারার সাথে সম্পর্কিত যাদের উদ্ভব হয়েছিল নূহ আলাইহিস সালামের নাতি ও সামের ছেলে ইরাম থেকে। ইতিহাসে আদদের এই শাখার আরো কয়েকটি উপশাখা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। সামূদ এদের অন্যতম। কুরআনে এই জাতিটির উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আরমিয়ান (Arameana) জাতি। এরা প্রথমে সিরিয়ার উত্তর এলাকায় বসবাস করতো। এদের ভাষা আরামী (Aramic)। সিরিয়ার ভাষাগুলোর মধ্যে এই ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

আদের জন্য ‘যাতুল ইমাদ’ (সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তারা বড় বড় উঁচু উঁচু ইমারত তৈরি করতো। দুনিয়ায় তারাই সর্বপ্রথম উঁচু উঁচু স্তম্ভের ওপর ইমারত নির্মাণ করার কাজ শুরু করে। কুরআন মজীদের অন্য জায়গায় তাদের এই বৈশিষ্ট্যকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ হযরত হূদ (আ) তাদেরকে বলেন,

اَتَبۡنُوۡنَ بِكُلِّ رِيۡعٍ اٰيَةً تَعۡبَثُوۡنَ

“তোমাদের এ কেমন অবস্থা, প্রত্যেক উঁচু জায়গায় অনর্থক একটি স্মৃতিগৃহ তৈরি করছো এবং বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করছো, যেন তোমরা চিরকাল এখানে থাকবে।” (আশ শু’আরা, ১২৮-১২৯)

৪.
অর্থাৎ তারা সমকালীন জাতিদের মধ্যে ছিল একটি তুলনাবিহীন জাতি। শক্তি, শৌর্য-বীর্য, গৌরব ও আড়ম্বরের দিক দিয়ে সে যুগে সারা দুনিয়ায় কোন জাতি তাদের সমকক্ষ ছিল না। কুরআনের অন্যান্য স্থানে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

وَزَادَكُمۡ فِىۡ الۡخَلۡقِ بَصۜۡطَةً‌‌ۚ

“দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে তোমাদের অবয়বকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। (আল আরাফ, ৬৯)

فَاَمَّا عَادٌ فَاسۡتَكۡبَرُوۡا فِىۡ الۡاَرۡضِ بِغَيۡرِ الۡحَقِّ وَقَالُوۡا مَنۡ اَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً‌ؕ

“আর তাদের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, তারা কোন অধিকার ছাড়াই পৃথিবীর বুকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করেছে। তারা বলেছেঃ কে আছে আমাদের চাইতে বেশী শক্তিশালী?” (হা-মীম আস্ সাজদাহ, ১৫)

وَاِذَا بَطَشۡتُمۡ بَطَشۡتُمۡ جَبَّارِيۡنَ“আর তোমরা যখন কারোর উপর হাত উঠিয়েছো প্রবল পরাক্রান্ত হয়েই উঠিয়েছো।” (আশ শু’আরা, ১৩০)

৫.
উপত্যকা বলতে ‘আলকুরা’ উপত্যকা বুঝানো হয়েছে। সামূদ জাতির লোকেরা সেখানে পাথর কেটে কেটে তার মধ্যে গৃহ নির্মাণ করেছিল। সম্ভবত ইতিহাসে তারাই প্রথম জাতি হিসেবে চিহ্নিত যারা পাহাড়ের মধ্যে এভাবে ইমারত নির্মাণের রীতি প্রচলন করেছিল। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আরাফ ৫৭-৫৯ টীকা, আল হিজর ৪৫ টীকা এবং আশ শু’আরা ৯৫-৯৯ টীকা)
৬.
ফেরাউনের জন্য ‘যুল আউতাদ’ (কীলকধারী) শব্দ এর আগে সুরা সাদের ১২ আয়াতেও ব্যবহার করা হয়েছে। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। তার সেনাবাহিনীকে কীলকের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং সেই অর্থে কীলকধারী মানে সেনাবাহিনীর অধিকারী। কারণ তাদেরই বদৌলতে তার রাজত্ব এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যেমন কীলকের সাহায্যে তাঁবু মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর অর্থ সেনা দলের সংখ্যাধিক্যও হতে পারে। এক্ষেত্রে এর অর্থ হবে, তার সেনাদল যেখানে গিয়ে তাঁবু গাঁড়তো সেখানেই চারদিকে শুধু তাঁবুর কীলকই পোঁতা দেখা যেতো। আবার এর অর্থ সেই কীলকও হতে পারে যা মানুষের শরীরে গেঁড়ে দিয়ে সে তাদেরকে শাস্তি দিতো। এও হতে পারে, মিসরের পিরামিডগুলোকে কীলকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ সেগুলো ফেরাউনদের পরাক্রম ও শান শওকতের নিদর্শন হিসেবে হাজার হাজার বছর থেকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
অনুবাদ: