সবরের ব্যাপারে ইতিপূর্বে আমি বারবার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি, কুরআন মজীদ যে ব্যাপক অর্থে এই শব্দটির ব্যবহার করেছে সে দৃষ্টিতে বিচার করলে মু’মিনের সমগ্র জীবনকেই সবরের জীবন বলা যায়। ঈমানের পথে পা রাখার সাথে সাথেই মানুষের সবরের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। আল্লাহ যেসব ইবাদাত ফরয করেছেন, সেগুলো সম্পাদন করতে গেলে সবরের প্রয়োজন। আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার ও সঠিকভাবে মেনে চলার জন্যও সবরের দরকার। আল্লাহ যেসব জিনিস হারাম করেছেন সবরের সাহায্য ছাড়া সেগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়াও কঠিন। নৈতিক অসৎবৃত্তি পরিহার করা ও সৎবৃত্তি অবলম্বন করার জন্য সবরের প্রয়োজন। প্রতি পদে পদে গোনাহ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। তার মোকাবেলা করা সবর ছাড়া সম্ভব নয়। জীবনের এমন বহু সময় আসে যখন আল্লাহর আইনের আনুগত্য করলে বিপদ-আপদ, কষ্ট, ক্ষতি ও বঞ্চণার সম্মুখীন হতে হয়। আবার এর বিপরীত পক্ষে নাফরমানির পথ অবলম্বন করলে লাভ, ফায়দা, আনন্দও ভোগের পেয়ালা উপচে পড়তে দেখা যায়। সবর ছাড়া কোন মু’মিন এ পর্যায়গুলো নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পারে না। তারপর ঈমানের পথ অবলম্বন করতেই মানুষ বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। নিজের সন্তান-সন্তুতির, পরিবারের, সমাজের, দেশের, জাতিরও সারা দুনিয়ায় মানুষ ও জ্বিন শয়তানদের। এমনকি তাকে আল্লাহর পথে হিজরত এবং জিহাদও করতে হয়। এসব অবস্থায় একমাত্র সবরের গুণই মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল রাখতে পারে। একথা সুস্পষ্ট যে, এক একজন মু’মিন একা একা যদি এই ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে, তাহলে তার সবসময় পরাজিত হবার ভয় থাকে। অতি কষ্টে হয়তো সে কখনো সাফল্য লাভ করতে পারে। বিপরীত পক্ষে যদি মু’মিনদের এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত থাকে, যার প্রত্যেকটি সদস্য সবরকারী হয় এবং এই সমাজের সদস্যরা সবরের এই ব্যাপকতর পরীক্ষায় পরস্পরকে সাহায্য সহায়তা দান করতে থাকে তাহলে সাফল্যের ডালি এই সমাজের পদতলে লুটিয়ে পড়বে। সেখানে পাপও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সীমাহীন শক্তির প্রবাহ সৃষ্টি হবে। এভাবে মানুষের সমাজকে ন্যায়, সততা ও নেকীর পথে আনার জন্য একটি জবরদস্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি হয়ে যাবে।
আর রহমের ব্যাপারে বলা যায়, ঈমানদারদের সমাজের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে, এটা কোন জালেম, নির্দয়, বেরহম, পাষাণ হৃদয় ও হৃদয়হীনদের সমাজ হয় না। বরং সমগ্র মানবতার জন্য এটি হয় একটি স্নেহশীল, কারুণা প্রবণ এবং নিজেদের পরস্পরের জন্য সহানুভূতিশীল ও পরস্পরের দুঃখে-শোকে-বেদনা অনুভবকারী একটি সংবেদনশীল সমাজ। ব্যক্তি হিসেবেও একজন মু’মিন হয় আল্লাহর করুণার মূর্ত প্রকাশ এবং দলগতভাবে ও মু’মিনদের দল আল্লাহর এমন এক নবীর প্রতিনিধি যার প্রশংসায় বলা হয়েছেঃ
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ(বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও করুণা হিসেবেই তোমাকে পাঠিয়েছি। আম্বিয়াঃ ১০৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের উম্মাতের মধ্যে এই রহম ও করুণাবৃত্তিটির মতো উন্নত নৈতিক বৃত্তিটিকেই সবচেয়ে বেশী প্রসারিত ও বিকশিত করতে চেয়েছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাঁর নিম্নোক্ত বাণী গুলো দেখুন। এগুলো থেকে তাঁর দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব কি ছিল তা জানা যাবে। হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রেওয়ায়াত করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لاَ يَرْحَمُ اللَّهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ
“যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না, আল্লাহ তার প্রতি রহম করেন না।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَانُ - ارْحَمُوا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ-
“রহমকারীদের প্রতি আল্লাহ রহম করেন। পৃথিবীবাসীদের প্রতি রহম করো। আকাশবাসী তোমার প্রতি রহম করবেন।”(আবু দাউদ ও তিরমিযী)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেনঃ مَنْ لاَ يَرْحَمُ لاَ يَرْحَمُ “যে ব্যক্তি রহম করে না তার প্রতি রহম করা হয় না।” (বুখারী ফিল আদাবিল মুফরাদ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا
“যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (তিরমিযী)
ইমাম আবু দাউদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরের বরাত দিয়ে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا ويعرف حق كَبِيرَنَا فلَيْسَ مِنَّا
“যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং আমাদের বড়দের হক চেনে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি আবুল কাসেম (নবী করীম) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
لاَ تُنْزَعُ الرَّحْمَةُ إِلاَّ مِنْ شَقِىٍّ
“হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় থেকেই রহম তুলে নেয়া হয়।” মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী)
হযরত ঈয়ায ইবনে হিমার (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তিন ধরনের লোক জান্নাতী। তার মধ্যে একজন হচ্ছেঃ
رَجُلٌ رَحِيمٌ رَقِيقُ الْقَلْبِ لِكُلِّ ذِى قُرْبَى وَمُسْلِمٍ
“যে ব্যক্তি প্রত্যেক আত্মীয় ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দয়ার্দ্র হৃদয় ও কোমল প্রাণ” (মুসলিম)
হযরত নু’মান ইবনে বশীর বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِى تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
“তোমরা মু’মিনদেরকে পরস্পরের মধ্যে রহম, ভালোবাসা ও সহানুভূতির ব্যাপারে একটি দেহের মতো পাবে। যদি একটি অঙ্গে কোন কষ্ট অনুভূত হয় তাহলে সারা দেহ তাতে নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রা.) বর্ণনা করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
“মু’মিন অন্য মু’মিনের জন্য এমন দেয়ালের মতো যার প্রতিটি অংশ অন্য অংশকে মজবুত করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীটি উদ্ধৃত করেছেনঃ
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ ، وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِى حَاجَتِهِ ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-
“মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না বরং তাকে সাহায্য করতেও বিরত হয় না। যে ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের কোন প্রয়োজন পূরণ করার কাজে লেগে থাকবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করার কাজে লেগে থাকবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে কোন বিপদ থেকে উদ্ধার করবে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিনের বিপদগুলোর মধ্যে থেকে একটি বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন করবে আল্লাহও কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
সৎকর্মকারীদেরকে ঈমান আনার পর ঈমানদারদের দলে শামিল হবার যে নির্দেশ কুরআন মজীদে এই আয়াতে দেয়া হয়েছে তার ফলে কোন্ ধরনের সমাজ গঠন করতে চাওয়া হয়েছে, তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তিগুলো থেকে জানা যায়।